বৌদ্ধ বিহারের যে বাস্তবতা হয় না জানা
লিখেছেন:-উপতিষ্য ভিক্ষু,রাঙ্গামাটি ।
|
ছবিতে উপাসক যা বলছেন তা নিষক একজনের নয় বরং একটি গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গীকে নির্দেশ করছে।
স্ক্রীনশট নেয়া ছবিটিকে খুব সাধারণ মনে হতে পারে অনেকেরই। হ্যাঁ সাধারণ
হতে পারে বটে তবে এই সাধারণ কথাটির মাঝে একটি ধ্রুব বাস্তবতা লুকিয়ে আছে
সেটি বলার জন্যই মূলত ছবিটি নেয়া। ছবিতে যা আছে তা হচ্ছে আমার একটি পোস্টে
মন্তব্য করতে গিয়ে একজন উপাসক আমাকে বলে ফেললেন "ভাগ্য তোমার ভালো আমাদের
বিহারে নও, তাহলে এতদিন চীবরটাও হারাতে..."। আমি তাতে তার উপর রাগ করিনি।
বরং তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ একটি বিষয় আমাকে বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। সেটি
হচ্ছে আমরা যারা ভিক্ষু হয়ে বিহারে থাকি (চাকমা আর বড়ুয়া দুটো সমাজেই
দেখেছি) আমাদের একটি বিষয় খুব দক্ষতার সাথে করতে হয়, তা হচ্ছে বিহার
সংশ্লিষ্ট সকলের মন রক্ষা করে চলা। বিশেষ করে অধ্যক্ষ ভান্তের জন্য এটি
বাধ্যতামূলক । আপনি হয়ত এতক্ষণ বলছেন তা আবার কেমন কথা । বিহারের ভান্তে
সকলের মন রক্ষা করে চলতে বাধ্য হন! আজব!! তাহলে শোনেন তার কিছু দিক আপনাদের
জ্ঞাতার্থে বলছি...
বিহারকে কেন্দ্র করে অনেক স্টেইক হোল্ডার থাকেন
। স্টেইক হোল্ডার মানে বুঝেন তো? যারা বুঝেন না তাদের জন্য বলছি বিভিন্ন
ধরনের স্বার্থ-সম্পর্কীয় পক্ষ । এদের মধ্যে আছেন গ্রাম্য মোড়ল,
ধনি-প্রভাবশালী, বিভিন্ন আদর্শের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ী ইত্যাদি ।
এরা সবাই বিহারকে ও এর ভান্তেকে তাদের পক্ষে রাখতে চায় । তখন ভান্তে'র
অবস্থা হয় অনেক সময় চাকমা প্রবাদ- রাঙা হালা ডিঙি শাক, এতারে হলে অতে
রাগ... এর মত। প্রায় সকল ভান্তেরই এই অভিজ্ঞতা আছে । ভান্তেরা কোন দিকে
যেতে পারে না, আবার চুপও থাকতে পারে না । ঠিক এরকম পরিস্থিতি থেকেই অনেক
সময় দেখা যায় ভান্তে'র বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি ভান্তে আর
উক্ত বিহারে থাকতে পারেন না । চুপচাপ অন্যত্র যেতে বাধ্য হন । এসব ভিতরের
খবর কিন্তু আমাদের মাঝে আসে না, আমরা ওই প্রোপাগান্ডায় মজগুল বনে যায় তখন ।
গত বছর আমি আমার মায়ের অসুস্থতার সময় বাড়িতে গিয়েছিলাম মাকে দেখতে ।
বাড়িতে গিয়ে আমার বাবার ছোট বেলার শিক্ষা গুরুর সাথে দেখা হয় সৌভাগ্যক্রমে ।
বয়স ষাট বছরের বেশি হবে । কথা বলার একসময় জানলাম সম্প্রতি তিনি ছয় বছরের
ভিক্ষু জীবন থেকে কাপড় ছেড়ে আবার গৃহ জীবনে ফিরে এসেছেন । জীবনের শেষ বেলায়
ভিক্ষু হয়ে জীবন কাটিয়ে দিবেন এই আশায় তিনি গেরুয়া বসন ধারণ করেছিলেন ।
কিন্তু বিধি বাম । যেরকম ভেবেছিলেন সেরকম পরিবেশ বিহারগুলোতে দেখেননি বলে
আবার গৃহ জীবনে ফিরে আসেন ।
আমরা স্বীকার করি বা না করি এসবই
বাস্তবতা । ভান্তেরা দায়কদের বুঝানোর কথা দূরে উল্টা অনেক সময় তারাই ঠিকতে
পারে না বিহারগুলোতে । সবাই তো আর নাগসেন ভান্তে হতে পারে না কিংবা পারে না
হতে বনভান্তে (অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠে ব্যবহৃত হয়েছেন বলে) । তো
বিহারগুলোর এমন পরিবেশে থাকা ভান্তেদের থেকে আমরা কতটুকুই বা আশা করতে পারি
সমাজের জন্য ।
একজন ভান্তে কোথাও ঠিকে থাকতে হলে তাঁর দায়কদের কাছ
থেকে চতুরপ্রত্যয় (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা) দরকার হয় বলেই
ত্রিপিটকে আছে । আর আমরা মনে করি শুধুমাত্র নিয়মিত পালা শোয়েং দিয়েই ভান্তে
রাজার চেয়েও সুখে আছে !! আমাদের সমাজ বিহার দান করে সংঘের কাছে । কিন্তু
আমার এখনো জানা হয়নি কোন সময় কোন বিহার দান করে ওই বিহারের যাবতীয় ডকুমেন্ট
সংঘের হাতে তুলে দিয়েছে বিহার দানকারী । বরং এটা সত্য যে নিজেদের ইচ্ছামত
বিহারের ভিক্ষু বদল করে যখন তখন । যতক্ষণ একজন ভিক্ষু শারীরিকভাবে সক্ষম ও
ভালো ভালো দেশনা দিতে পারেন ততক্ষণ তাঁর কদর থাকে দায়ক সমাজে । বুড়ো হলে
কিংবা সুন্দর সুন্দর দেশনা দিতে না পারলে সেই ভান্তের দিকে আমরা ফিরেও
তাকায় না । তাই অনেক আবাল্য ব্রহ্মচারী ভান্তেদের শেষ জীবনে যুবক ভিক্ষুদের
পরামর্শ দিতে শুনেছি- "সময় থাকতে কাপড় ছেড়ে যাও । না হলে তোমাদেরও আমাদের
মতই পরিণতি হবে দেখ"। তাঁদের এমন করুণ আর্তির উপদেশ শুনে আমার রবিন্দ্রনাথ
ঠাকুরের 'সোনার তরী' কবিতাটির কয়েকটি চরণ মনে পরে......"ঠাই নাই ঠাই নাই
ছোট সে তরী...আমারি সোনার ধানে গিয়াছে ভরি "। এই ধরনের কথা খোদ রাজগুরু
ভান্তের কাছ থেকেও শেষ জীবনে শুনেছি । তিনি উপদেশ দিয়েছেন আমার সতীর্থ বড়
ভাইকে এই বলে যে- "লেখা পড়া করছ? টাকা কামাও । টাকার দরকার আছে ।" মনে
প্রশ্ন জাগে তবে কি সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজগুরু ভান্তেও ভুল করেছেন ???
দায়কদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম আছে । কিন্তু ভান্তেদের জন্য সেরকম কোন বৃদ্ধাশ্রম
নেই । আমার যদি সামর্থ্য থাকত তাহলে আমি বয়স্ক অসহায় ভান্তেদের জন্য একটি
ভিক্ষু বৃদ্ধাশ্রম করতাম । যে ভান্তেরা সমাজের মরা-মৃত্যু থেকে শুরু করে
বিভিন্ন বিপদ-আপদ ও মঙ্গলময় কাজ করতে করতে জীবন নিঃশেষ করেছেন, তাঁদের সেই
শেষ সময়ের নিভু নিভু জীবন প্রদীপ অন্তত শান্তিতে নিবে যেতে পারার সুযোগ
দিতাম ।
সমাজের একেবারেই নিষ্পেষিত ও অবহেলিত হতদরিদ্র পরিবার থেকে
অনেক সময় বুদ্ধ ধর্ম ও সংঘের আশ্রয়ে কিছু কিছু জুম্ম ভিক্ষু উচ্চ শিক্ষিত
হয়ে অসহায় মানবতার সেবাব্রতী প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেন মহান আদর্শ ও লক্ষ্যকে
সামনে রেখে । বহু ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে তিল তিল করে গড়ে তোলা ওই সকল
প্রতিষ্ঠান যখন একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাড়িয়ে যায় তখন সেসকল প্রতষ্ঠানও
কথিত গণতান্ত্রিক প্রগতিশীলদের হাতে চলে যায় । একবার আমাকে উপসংঘরাজ ভান্তে
মহোদয় যা বলেছিলেন তা বাংলায় তর্জমা করলে দাড়ায়... "আমরা শুরু থেকেই অনেক
কষ্টে যখন প্রতিষ্ঠান চালিয়ে আসছি তখন কোন ঝামেলা বা ভুল তেমন ধরা পড়েনি ।
আর এখন এসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষিতদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে বলে তারা আমাদের
অনেক ভুল খুঁজে পেয়েছেন । আমরা তো অশিক্ষিত!! সম্ভবত তাই জানি না, বুঝি না
এসব!!"
আমাদের ক্ষুধার্থ সমাজ শুধু নিতেই জানে, দিতে জানে না । যা
দেয় তা সম্ভবত শুধু সমালোচনা । এখন আমরা আমাদের মহান ভিক্ষু সংঘকে
সমালোচনার নামে গালমন্দ পারি, তাঁদের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামী ইতিহাসকে
অস্বীকার করছি, রাজার চেয়েও সুখে আছে বলে তিরস্কার করছি সকল ভিক্ষুকে । এই
অপ্রিয় বাস্তবতা আমাদের অনেক তরুণ ভান্তের মনকে বিষিয়ে তুলছে । তারা উৎসাহ
হারাচ্ছে উদ্যেক্তা হতে ও দিন দিন আত্নমুখী হচ্ছে। এসব যখন ভাবি তখন হঠাৎ
যেন মনে হয় ভবিষ্যতের এক গভীর অনিশ্চয়তা আমাদের হাতছানি দিচ্ছে !! এটাই কি
হওয়ার কথা ছিল বা আমরা কি হতে দিবো সত্যি??
|
About the Author
Posted by Unknown
on 01:12. Filed under
Bangla
.
You can follow any responses to this entry through the RSS 2.0.
Feel free to leave a response
By Unknown
on 01:12. Filed under
Bangla
.
Follow any responses to the RSS 2.0. Leave a response