Published On:Monday, 27 October 2014
Posted by Unknown
বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদবে...?
রামু ট্র্যাজেডি : হাজার বছরের বৌদ্ধ-ঐতিহ্য ধ্বংসের দুই বছর
লিখেছেন- শ্যামল চৌধুরী
যখন কোন রাষ্ট্রে কোনপ্রকার অপরাধ সংঘটিত হয়, তখন তার জন্য আইনের শাসন আছে, তা যথাযথ প্রয়োগের ব্যবস্থা আছে। যখন কোন দুষ্কর্ম, নাশকতা, সন্ত্রাসী বা অন্য যেকোন অপরাধ কর্মকান্ড সংঘটিত হয়, তখন তাকে আইনের আওতায় এনে বিচারের বিধান রয়েছে। এ কথা আমরা সবাই জানি এবং বুঝি। কিন্তু অনেক কিছু অপরাধকর্মের বিচারের জন্য রাস্তায় দাবী জানাতে হয়, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ-মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি দিয়ে দিনের পর দিন বিচারের আশায় থাকতে হয়..! যদি দেখা যায় এটা অপরাধকর্ম, তাহলে সেটা আইনের আওতায় আসা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কেন সেটার জন্য আলাদাভাবে বিচারের দাবী জানাতে হবে? দেশে যদি আইনের প্রকৃত শাসন থাকে তাহলে এ প্রশ্ন উঠার কথা নয়।
আমাদের দেশের একটা ট্র্যাডিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যখন কোন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সৃষ্টি হয় তখন অন্যের ওপর দায় দিয়ে সরকার দায়িত্ব পালন করে থাকে। পাশাপাশি আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সাহায্য দিয়ে প্রকৃত ঘটনার আলামত তথা তথ্য-তদন্তের প্রতি তেমন কোন ভ্রুক্ষেপ করে না। আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা হয়ে চলেছে। বিগত ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, শনিবার রাতে ও ৩০ সেপ্টেম্বর, রবিবার দুপুরে যথাক্রমে কক্সবাজারের রামু-উখিয়া ও চট্টগ্রামের পটিয়ার লাখেরা-কোলাগাঁও গ্রামে একদল সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতকারীদের হামলায় লণ্ডভণ্ড হয়েছে ৩০০/৪০০ বছরের ১৬টি বৌদ্ধ বিহার। লুটপাট করে বুদ্ধমূর্তি সহ বহু মূল্যবান দুর্লভ সম্পদ। তারা বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অর্ধ শতাধিক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। দুষ্কৃতকারীদের এ নারকীয় তাণ্ডবে এলাকাবাসী নির্বাক ও হতভম্ব হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ অসহায় তাকিয়ে দেখে এ দুষ্কর্ম। চোখের সামনেই নিমিষেই ধ্বংস হতে চলেছে তাদের পূজা-উপাসনার পবিত্র স্থান। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ খবর ভেসে আসে। এ ঘটনার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠে বিশ্ববিবেক। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ-প্রতিবাদে এ ঘটনার নিন্দা প্রকাশ করা হয়।
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত রামুতে সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতকারীরা বৌদ্ধদের উপাসনালয়, প্যাগোডা ও বৌদ্ধবসতিতে হামলা চালালো। অথচ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতি নিকটেই দীর্ঘ সময় ধরে এ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। ভাঙচুর-লুট হয়েছে অনেক মূল্যবান সম্পদ বুদ্ধমূর্তি, পুরনো বইয়ের পাণ্ডুলিপি তথা হাজার বছরের বৌদ্ধ ঐতিহ্য। বিনষ্ট হয়েছে হাজার হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। সৃষ্টি হয়েছে এক ভীতিকর পরিবেশ যেখানে মানুষ তো দূরে থাক স্বয়ং অন্য কোন প্রাণীও জীবন-যাপনে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, ঘটনার পরদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর রামুর ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময়কালীন দিন-দুপুরে পটিয়ায় দু’টি বৌদ্ধ বিহারে ভাঙচুর-লুটপাট করা হলো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রামুতে তার বক্তব্যে বললেন, এটা বিরোধী দলের পূর্ব পরিকল্পনামাফিক হামলা। সাথে সাথে বিরোধীদলও সরকারকে দোষারোপ করে পাল্টা বিবৃতি দিলো। এতেই আক্রান্ত বৌদ্ধরা ছাড়াও প্রগতিশীল নাগরিকদের মধ্যে হতাশার দানা বাঁধতে শুরু করলো। এই ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক কাঁদা ছোড়াছোড়ি হোক তা তাঁরা চান না। তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে, এটা তাদেরই কাজ। অপরদিকে বিরোধীদলের যেটা করার তা করেছেন। পাল্টা অভিযোগ তুলে সরকারকে সমুচিত জবাব দিয়েছেন।
স্থানীয় আক্রান্ত বৌদ্ধদের মতে, দীর্ঘ সময় ধরে চলা ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে পুলিশ ওয়াকিবহাল ছিল, তা না হলে কেন পুলিশ কোন তড়িৎ পদক্ষেপ নিলো না..? এমনিতেই দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর আচরণ ও ভূমিকা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ..! পত্রিকান্তরে প্রকাশÑ রামুর ঘটনার দিন পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সহ অনেকেই উসকানি-ইন্ধন দিয়েছে। সরকারের মন্ত্রী-নেতারা বলেছেন বৌদ্ধদের ওপর হামলার ঘটনাটি পূর্ব পরিকল্পিত। যেকোন মানুষের অবস্থাদৃষ্টে মনে হবে পূর্ব পরিকল্পনা না থাকলে অত দ্রুত এতসব লোকজন সংগঠিত করা সম্ভব ছিল না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একটি জনগোষ্ঠীর ওপর এমনতর আঘাত করার পরিকল্পনা সরকারের দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিছুই আঁচ করতে পারল না? দুষ্কৃতকারীরা কি এতই শক্তিশালী ছিল?
যা হোক, ঘটনার পরপরই সরকার পরিকল্পনা করলেন রামুর বৌদ্ধ বিহার ও প্যাগোডাগুলো পুননির্মাণ করে দেওয়ার। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে আধুনিক নির্মাণ শৈলী ও পুরনো ঐতিহ্যের মিশেলে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলো। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে পটিয়ার বৌদ্ধ বিহারগুলো সংস্কারের তেমন কোন ছোঁয়া আজো পরিলক্ষিত হয়নি। ইতোমধ্যে জার্মান সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় ও স্থানীয় বৌদ্ধদের প্রচেষ্টায় কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে।
গত ৩ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারের রামুতেই পুননির্মিত সকল স্থাপনার শুভ উদ্বোধন করলেন। তবে সবকিছু নতুন আঙ্গিকে ফিরে পাওয়া গেলেও কোন কিছুর বিনিময়েও কি ফিরে পাওয়া সম্ভব সেই পুরাকীর্তি-মূল্যবান বুদ্ধমূর্তি, পুরনো বইয়ের পাণ্ডুলিপি কিংবা হাজার বছরের বৌদ্ধ-ঐতিহ্য। এ কথা নিঃসন্দেহে অনুমেয় যে, বৌদ্ধদের ঐতিহ্যের উপর হামলায় শুধুমাত্র বৌদ্ধ সম্প্র্রদায় বা জনগোষ্ঠীর অপূরণীয় ক্ষতি হয়নি, বাঙালি হারিয়েছে তার হাজার বছরের লালিত অহংকার, হাজার বছরের সভ্যতা-সংস্কৃতি।
আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান চার সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী সুদূর অতীত থেকে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধনে বসবাস করে চলেছে। কোন অশুভ পরাশক্তির সামাজিক নিরাপত্তা ধ্বংস করার অপচেষ্টাকে প্রতিহত করাই এখন সুশীল সমাজের দাবি। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, উক্ত ঘটনার বিচার প্রক্রিয়ায় স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। গত দুই বছরেও ঘটনার কোন কুল-কিনারা তো দূরের কথা, ঘটনায় জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের পর্যন্ত এখনো গ্রেফতার করে বিচারের কাটগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। জনমনে প্রশ্ন, প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে কেন? আমাদের দেশের শাসনতন্ত্রের প্রকৃত প্রয়োগ হলে আর কোন ব্যক্তি, কোন গোষ্ঠী বা ক্ষতিগ্রস্তদের রাস্তায় নেমে বিচার চাইতে হতো না। আমাদের একে অপরকে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে ত্যাগ করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতেও এ ধরনের সংঘবদ্ধ হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। প্রশ্ন থেকেই যায়, সেই চিরাচরিত উক্তির মতো- ‘বিচারের বাণী শেষ পর্যন্ত কি নিভৃতেই কেঁদে যাবে’...?
লেখকঃ সংস্কৃতকর্মী, প্রাবন্ধিক ও গীতিকার। সম্পাদক, অমিতাভ ( সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা)
E-mail: amitabhactg@yahoo.com