Published On:Friday, 31 October 2014
Posted by Unknown
সাধু সাধু সাধু’ ধ্বনিতে মুখরিত রাজবন বিহার: কঠিন চীবর দানোৎসবে লাখো পুণ্যার্থী
সাধু সাধু সাধু’ ধ্বনিতে মুখরিত রাজবন বিহার: কঠিন চীবর দানোৎসবে লাখো পুণ্যার্থী
রাঙামাটিতে কঠিন চীবর দানোৎসবে গতকাল চীবর দান করেন চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় |
রাঙামাটি রাজবন বিহারে লাখো পুণ্যার্থীর অংশগ্রহণে শেষ হলো দুই দিনব্যাপী
৪১তম কঠিন চীবর দান উৎসব। এ উৎসবকে ঘিরে গত দুই দিন রাঙামাটি শহর ছিল যেন
উৎসবের নগরী। এ ধর্মীয় উৎসব পরিণত হয়েছিল পাহাড়ি-বাঙালির মিলনমেলায়।
রাঙামাটি রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবিরের দেশনার মাধ্যমে চীবর দান উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।
গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে রাজবন বিহারের মাঠের বিশাল এলাকাজুড়ে শুরু
হওয়া বর্ণাঢ্য বস্ত্র ও কল্পতরু শোভাযাত্রা মুহুর্মুহু আনন্দধ্বনি এবং
উৎসবের জোয়ার প্রকম্পিত করে। ভোর থেকেই বিহার চত্বরে জড়ো হতে থাকেন
পুণ্যার্থীরা। এসময় হাজারো মানুষের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠে রাজবন বিহারের
বিশাল এলাকা।
প্রয়াত বনভান্তের শিষ্যবর্গ ও অনুত্তর ভিক্ষুসংঘ অনুষ্ঠান মঞ্চে উপসি’ত হলে
ভক্তদের ‘সাধু, সাধু, সাধু’ ধ্বনিতে সমগ্র এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। বেলা
আড়াইটায় দানোৎসবের প্রথম পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ভক্তদের পঞ্চশীল গ্রহণ। পরে
পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হয় সংঘদান, অষ্টপরিষ্কার দান, বুদ্ধমূর্তি দান,
পুণ্যার্থীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তৈরি করা কঠিন চীবর উৎসর্গ।
বিকেলে সমবেত পুণ্যার্থীদের উদ্দেশে ধর্মীয় দেশনা দেন বৌদ্ধধর্মীয় অন্যতম
গুরু মহামতি বনভান্তের প্রধান শিষ্য শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার মহাস’বির। এসময়
উপসি’ত ছিলেন চাকমা সার্কেল চিফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, নতুন চাকমা
রানি ইয়ান ইয়ান, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিখিল কুমার
চাকমা, জেলা প্রশাসক মোস্তফা কামাল, পুলিশ সুপার আমেনা বেগম, অতিরিক্ত
পুলিশ সুপার আবুল কালাম আযাদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) অনুপ
চাকমা, রাজবন বিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদের কর্মকর্তাসহ পাহাড়ের নেতৃস’ানীয়
ব্যক্তিবর্গ।
গত বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় সুতা কাটা থেকে বুনন শুরু করে চীবর তৈরি শেষে
গতকাল শুক্রবার বিকাল ২টা ৫০ মিনিটে চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার
মহাস’বিরকে চীবর উৎসর্গ করার মাধ্যমে দান কার্য সম্পাদন করেন। এরপর
আনুষ্ঠানিকভাবে চীবর দান অনুষ্ঠান শুরু হয়।
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদানকালে রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন,
‘এ কঠিন চীবর দানের মধ্য দিয়ে শান্তির প্রতি শ্রদ্ধা ও গভীরতা বৃদ্ধি পায়
এবং সকলেই সংকল্পবদ্ধ হয়ে সকল প্রকারের হানাহানি ও হিংসার অবসানের মধ্য
দিয়ে এ অঞ্চল ও সারাদেশে সত্যিকার অর্থে জনমুখী ও পরিবেশমুখী উন্নতি আনতে
পারি সে লক্ষ্যে কাজ করতে পারি। এ কঠিন চীবর দানের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের জুম
চাষের প্রথার মাধ্যমে জুমের যে তুলা রয়েছে তা থেকে সুতা তৈরি করে চীবর
তৈরি হয়ে থাকে। এতে একদিকে আমাদের বৌদ্ধ ধর্মীয় কৃষ্টি সংরক্ষিত হচ্ছে
অন্যদিকে পার্বত্য এলাকার জুমিয়াদের কৃষ্টিও সংরক্ষিত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘নারী-পুরুষ সকলে মিলে আমাদেরকে একসাথে কাজ করতে হবে। দেশের সকল
ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।’ এদিকে, রাজা
দেবাশীষ রায় ভারতের মহারাষ্ট্র থেকে আগত ১৪০ জন উপাসক-উপাসিকাকে রাজবন
বিহারের কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানে উপসি’ত হওয়ায় ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য প্রদানকালে পার্বত্য জেলা পরিষদ
চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা বলেন, ‘বনভান্তে নেই তা আমাদের মনে হয় না।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তের বদৌলতে তার এ অনবদ্য কর্মযজ্ঞ আমাদের সকলের মাঝে
প্রেরণা যুগিয়েছে। আমরা সকলে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাই। সমাজের মধ্যে
যে অহিংসা হানাহানি কুসংস্কার চলছে তা সকলকে বন্ধ করতে হবে। চিত্তকে
পরিশুদ্ধ করার জন্য এবং এবং ধর্মীয় সুধা পান করার জন্য সকলকে একে অপরের
প্রতি সহনশীল মনোভাব গড়ে তুলতে হবে।’
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন রাজবন বিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদের
সিনিয়র সহ-সভাপতি গৌতম দেওয়ান, সহ-সাধারণ সম্পাদক অং থোয়াই মারমা,
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শুভেচ্ছাবাণী প্রদান করেন পার্বত্য জেলা পরিষদ
চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার শুভেচ্ছা
বাণী প্রদান করেন জেলা বিএনপি’র সভাপতি এডভোকেট দীপেন দেওয়ান।
প্রসঙ্গত, আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে গৌতম বুদ্ধের উপাসিকা
বিশাখা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা কেটে বৌদ্ধ পুরোহিতদের ব্যবহার্য
চীবর (বস্ত্র) তৈরি করে দানকার্য সম্পাদন করার পদ্ধতিতে এ কঠিন চীবর দান
প্রবর্তন করেন। আষাঢ়ী পূর্ণিমায় ভিক্ষুসংঘের যে তিন মাস বর্ষাব্রত শুরু হয়
তা শেষ হয় আশ্বিনী বা প্রবারণা পূর্ণিমায়। তারপর শুরু হয় মাসব্যাপী কঠিন
চীবর দানোৎসব। প্রতি বছরের মতো এবছরও কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশ
থেকে হাজার হাজার ভক্ত-অনুরাগী অংশ নেন। রাজবন বিহারে ১৯৭৪ সালে এক
স্বর্গীয় অনুভূতিতে বনভান্তে বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে সর্বপ্রথম কঠিন চীবর
দান প্রচলন করেন। এর আগে রাঙামাটি জেলার তিনটিলা বৌদ্ধ বিহারে ১৯৭৩ সালে এ
কঠিন চীবর দান করা হয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা কেটে তারপর চীবর
তৈরি করে বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী কঠিন চীবর
দান একমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজবন বিহারেই সম্পাদন করা হয়ে থাকে।
সৌজন্যেঃ সুপ্রভাত বাংলাদেশ